বিনোদন

কিংবদন্তি হুমায়ুন ফরীদির চলে যাওয়ার ১১ বছর

কিংবদন্তি হুমায়ুন ফরীদির চলে যাওয়ার ১১ বছর
- শিরিন আক্তার মুন্নি 
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে মারা যান বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। তার মৃত্যুর ১১ বছর আজ। হুমায়ুন ফরীদির চলে যাওয়ার ১১ বছর পরও তিনি বেঁচে আছেন তার ভক্তদের মাঝে তার অভিনয় কুশলতার জন্য। কিছু মানুষ আছেন যারা তার চলে যাওয়া এখনো মানতে নারাজ। অন্তত তাদের জন্য মন খারাপের দিন আজ।  চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও টেলিভিশনে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। তাকে বলা হতো অভিনয় কারিগর। বাংলাদেশের নাট্য ও সিনেমা জগতে তিনি অসাধারণ ও অবিসংবাদিত চরিত্রে অভিনয়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।

হুমায়ুন ফরীদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল দীনের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নাট্য উৎসবে তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন এবং নাট্যাৎসবের প্রধান আয়োজক হিসেবে কাজ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নব্বইয়ের দশকে হুমায়ুন ফরীদি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। নাট্যাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাকে সম্মাননা প্রদান করে। মাতৃত্ব চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে চলচ্চিত্র সম্মাননা পান ২০০৪ সালে। ২০১৮ সালে শিল্পকলায় একুশে পদক (মরণোত্তর)

স্বাধীনতা উত্তরকালে বাঙালির নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক গঠনে গ্রাম থিয়েটারের ভূীমকা অসামান্য। ঢাকা থিয়েটারের মূল সঞ্চালক ছিলেন মাত্র কয়েক জন নাট্য ব্যক্তিত্ব যেমন সেলিম আল দিন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্ছু, আফজল হোসেন, গোলাম মোস্তফা, পিযূস বন্দোপাধ্যায়, সুবর্ণা মোস্তফা এবং হুমায়ুন ফরীদি। তিনি বেশ কিছু মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন।

হুমায়ুন ফরীদির নিখোঁজ নাটকের মধ্যদিয়ে টেলিভিশন নাটকে অভিষেক ঘটে ছিল। হুমায়ুন ফরীদি নীল নক্সার সন্ধানে (১৯৮২), দূরবীন দিয়ে দেখুন (১৯৮২), ভাঙ্গনের শব্দ শুনি(১৯৮৩), বকুলপুর কত দূর,(১৯৮৫), দু’ভুবনের দুই বাসিন্দা, একটি লাল শাড়ি, মহূয়ার মন (১৯৮৩), সাত আসমানের সিঁড়ি(১৯৮৬), একদিন হঠাৎ (১৯৮৬), চান মিয়ার নেগিটিভ-পজেটিভ(১৯৯০), ওযাত্রা (১৯৮৭), সংসপ্তক (১৯৮৭-৮৮), পথের সময় (১৯৮৯), তিনি একজন (২০০৫), চন্দ্রগ্রস্ত (২০০৬), কাছের মানুষ (২০০৬), মোহনা(২০০৬), ভবের হাট (২০০৭), শূংখল (২০১০), প্রিয়জন নিবাস (২০১১), আরমান ভাই দি জেন্টালম্যান (২০১১) ইত্যাদি নাটকে সফল অভিনয় করেন।

তিনি ১৯৮৪ সালে তানভীর মোকাম্মেলের হুলিয়া স্বদৈঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে শেখ নিয়ামত আলীর দহন চলচ্চিত্র দিয়ে। তিনি একাধারে আর্ট ফিল্ম এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। হুমায়ুন ফরীদির অভিনিত কয়েকটি চলচ্চিত্র হল হুলিয়া, ব্যাচেলর, আহা, আতূত্ব, বহুব্রীহী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া ও একাত্তরের যিশু। তিনি মাতৃত্ব চলচ্চিত্রের জন্য ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র ‍পুরুস্কার লাভ করেন। তিনি অভিনয় দিয়ে সবসময় মানুষের মনজয় করেছেন।

হুমায়ুন ফরীদি সংশপ্তক নাটকে কানকাটা রমজান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন। এ ছাড়াও তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো,  কীর্ত্তনখোলা, মুন্তাসির ফ্যান্টাসি, কিরামত মঙ্গল(১৯৯০), ধূর্ত উই ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য মঞ্চায়ন। মঞ্চের পাশাপাশি টিভি অভিনয়েও হুমায়ুন ফরিদী ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। তার অভিনীত নাটকগুলো হল নিখোঁজ সংবাদ, হঠাৎ একদিন, পাথর সময়, সংশপ্তক, সমুদ্রে গাংচিল, কাছের মানুষ, মোহনা, নীল নকশাল সন্ধানে (১৯৮২), দূরবীন দিয়ে দেখুন (১৯৮২), ভাঙ্গনের শব্দ শুনি (১৯৮৩), কোথাও কেউ নেই, সাত আসমানের সিঁড়ি, সেতু কাহিনী (১৯৯০), ভবের হাট (২০০৭), শৃঙ্খল (২০১০), জহুরা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, প্রতিধ্বনি,গুপ্তধন, সেই চোখ, অক্টোপাস, বকুলপুর কত দূর, মানিক চোর, আমাদের নুরুল হুদা, সন্ত্রাস, দহন, লয়াকু, দিনমজুর,বীর পুরুষ, বিশ্ব প্রেমিক, আজকের হিটলার, দুর্জয়,শাসন, আঞ্জুমান, আনন্দ অশ্রু মায়ের অধিকার, আসামী বধু, একাত্তরের যীশু, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, ভালোবাসি তোমাকে, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, প্রবেশ নিষেধ, ভন্ড, অধিকার চাই, মিথ্যার মৃত্যু, বিদ্রোহী চারিদিকে, মনে পড়ে তোমাকে, মাতৃত্ব, টাকা, ব্যাচেলর, জয়, যাত্রা, শ্যামল ছায়া, দূরত্ব, চেহারা, আহা, কি যাদু করিলা, মেহেরজান প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করে হুমায়ুন ফরিদীর চলচ্চিত্রে খ্যাতির পরিধি আরো প্রসারিত হয়।

জীবন কেমন? এই প্রশ্নের উত্তরে হুমায়ুন ফরীদি বলেছিলেন, জীবন একটা চমৎকার ব্যাপার, যাকে আকঁড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া হয়, সে ছেড়ে চলে যায়। তবু ও জীবন উপভোগ্য, জীবন সুন্দর। হুমায়ুন ফরীদি তার জীবনকে পুরোটা উজাড় করে দিয়ে যাপন করেছেন। তিনি সেখানে দুঃখগুলো সুনিপুণ বাসা বেধেঁছিলেন সুখের দালানের এক কোণে। তিনি বার বার প্রেমে পড়েছিলেন। সে সব প্রেম সময়ের সাথে সাথে ভেঙে গেছে। কিন্তু অভিনয়ের প্রেমে একবারই পড়েছেন, সেই প্রেম জীবনের শেষ মুহূর্তে ও ছিল।

হুমায়ুন ফরীদি ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এটিএম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণের পর চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়াশোনা করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে দুইুটি বিয়ে করেছেন হুমায়ুন ফরীদি। স্বাধীনতার পর হুমায়ুন ফরীদি তার সহপাঠীর বোন নাজমুন আরা বেগম মিনুর গলায় বেলী ফুলের মালা দিয়ে  বিয়ে করেছিলেন। হুমায়ুন ফরীদি ও মিনুর সংসারে এক সন্তান রয়েছে নাম শারারাত ইসলাম দেবযানী। মিনু তাঁকে বোহেমিয়াম জীবন থেকে সংসারের সাজানো শয্যা পেতে দিয়েছিলেন। কিন্তু ধরে রাখতে পারেন নি। পরবর্তীতে অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফাকে বিয়ে করেছিলেন। হুমায়ুন ফরীদি না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর চার বছর আগে অর্থাৎ ২০০৮ সালে সে বন্ধন ও ভেঙে যায়।

বাংলাদেশী নাট্য, চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা ও নাট্য সংগঠক হুমায়ুন ফরীদি ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তার নিজ বাড়িতে মূত্যু বরণ করেন। মূত্যুর আগে তাকে ঢাকার মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়ার জন্য। সুস্থ হয়ে বাসায় আসার পর তিনি বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান এবং এই আঘাতে তার মূত্যু হয়। মূত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৬০ বছর।

শিরিন আক্তার মুন্নি , নাট্য শিল্পী 

ছবিঃ সংগৃহিত