উপ - সম্পাদকীয়

যুদ্ধ নয়; শান্তি চাই - শফিকুল আলম

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার নিউক্লিয়ার এবং কেমিকাল অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা কতো টুকুন?

এ সংক্রান্ত James Dwyer এর বিশ্লেষন পড়া যাক্। (James সোসাল সায়েন্স এর ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার একজন এ্যাসোসিয়েট লেকচারার এবং পিএইচডি স্টুডেন্ট)। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং সামরিক আক্রমনের তিন সপ্তাহ চলছে। পুতিন এবং রাশিয়ার ভাবনানুযায়ী কোনো কিছু এগোচ্ছেনা। রাশিয়া প্রথম সপ্তাহে যা’ অর্জনের পরিকল্পনা করেছিলো তা’ অর্জিত হয়নি।

সময় যতো বেশী অতিক্রান্ত হবে পুতিন এবং রাশিয়া ততো বেশী ধৈর্য হারাবে এবং দিকভ্রান্ত হবে। রাশিয়ার সকল পদক্ষেপ তখন উন্মত্ত হবে এবং ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারে উদ্দীপ্ত হবে। কোন্ পরিস্থিতিতে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে? 

যুদ্ধ বেশী সময় অতিক্রান্ত হলে পুতিন অশান্ত উন্মাদ হয়ে প্রথমেই ব্যাপক বিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন। রাশিয়ার সবচাইতে বড় রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। তাদের রয়েছে Sarin এবং VX (Nerve agents), তাদের রয়েছে mustard gas এবং toxic gas phosgene।

যদিও রাশিয়া দাবী করে থাকে যে তারা ২০১৭-তে আর্সেনাল ধ্বংস করে দিয়েছে তবুও ২০১৮-তে একটি হত্যা প্রচেষ্টায় তাদের গোয়েন্দা সংস্থাকে চেতনা নাশক Novichok ব্যবহার করতে দেখা গেছে। বরং ২০২০ এর গোয়েন্দা রিপোর্ট বলে তারা বরং অধিক হারে রাসায়নিক অস্ত্রের উৎপাদন এবং মজুদ বৃদ্ধি করেছে। তবে পরিমান নিশ্চিত করা যায়নি।

এক্ষেত্রে ‘False Flag Attack’ হতে পারে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে ব্লেইম দিয়ে তাদের ওপর আক্রমন করা। যেটি ইরাক আক্রমনে আমেরিকা করেছিলো। আমেরিকা বলেছিলো ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে। কিন্তু পরিশেষে আমেরিকা প্রমান করতে পারেনি ইরাকে কোনো রাসায়নিক অস্ত্র ছিলো। এক্ষেত্রে রাশিয়া তাদের সৈন্যদের ওপর নিজেরাই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেনে যেকোনো সময়ে রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগের ন্যায্যতা সৃষ্টি করতে পারে।

অথবা ইউক্রেনের অধিকৃত যেকোনো অন্চলে তারা নিজেরাই রাসায়নিক অস্ত্র মজুদ করে তা’ খুঁজে বের করে বলতে পারেন ইউক্রেনে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে। অতপর এই মারাত্মক ব্যাপক বিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্রের সমাহার নিশ্চয়ই প্রতিবেশী রাশিয়াকে আক্রমনের জন্য ইউক্রেন রেখেছে। আর তখনই রাশিয়ার অধিকার সৃষ্টি হলো ইউক্রেনের ওপর রাসায়নিক এবং আনবিক অস্ত্র ব্যবহারের!! 
যেকোনো অজুহাতে যেকোনো পক্ষ এই mass destruction অস্ত্রের ব্যবহার করলে তার পরিনাম হবে ভয়াবহ। সেই সমস্ত এলাকায় বহুকাল মানুষের চিহ্ন থাকবেনা এবং মনুষ্যের বাসযোগ্য থাকবেনা। ঐ সমস্ত এলাকায় কোনো প্রাণী নিঃশ্বাস নিতে পারবেনা

বিশেষ করে এই nerve agent চামড়ার সংস্পর্শে এলেই মুহূর্তের মধ্যে নির্ঘাত মৃত্যু (even a single touch)। এমনকি কেমিকালযুক্ত পুরো এরিয়ায় কেহ প্রবেশ করতে পারবেনা। এমনকি রাশিয়ান সৈন্যদের কাছে বা তাদের পরিধানে এমন কোনো PPE(Personal Protective Equipment) নেই যে তারা নিজেরা এই মারাত্মক কেমিকাল এজেন্ট থেকে রক্ষা পাবে। তা’হলে এই ধরনের মারাত্মক অস্ত্রের ব্যবহার সুস্থ মস্তিস্কের কাজ হবে?

রাশিয়ার কাছে পৃথিবীর সব দেশের চাইতে বেশী নিউক্লিয়ার আর্সেনাল রয়েছে। তাদের কাছে Tactical nuclear(short ranged missiles) weapons এবং Strategic nuclear weapons (long ranged missiles) রয়েছে ৪,৪৭৭টি যার মধ্যে Tactical nuclear weapons হচ্ছে ১৯১২টি। ধারনা করা হচ্ছে রাশিয়া Tactical nuclear weapons ব্যবহার করতে পারে। যেহেতু তাদের সৈন্য ইউক্রেনের ভেতরে রয়েছে সেহেতু যুদ্ধক্ষেত্রে কম দূরত্বে এই আর্সেনাল ব্যবহার করতে পারে। দূর থেকে সাধারনত কোনো নগরী টার্গেট করে Strategic missiles ব্যবহার করে তা’ ধ্বংস করে 
দেয়া হয়।

সাধারনত আর্টিলারী Tactical missiles ব্যবহার করে থাকে। আধুনিক Tactical nuclear weapons এর ক্ষমতা এমনকি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে নিক্ষেপিত আনবিক বোমার থেকেও শক্তিশালী। এমনকি প্রতিপক্ষের অনেক বড় এবং গভীর কুপ উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে Tactical nuclear weapon। এই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার যেকোনো সময় ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাবুহ্য ভেঙ্গে দিতে পারে।
আরও বিষয় হলো এই ধরনের আক্রমনে প্রস্তুতি নির্নয় করা বা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার সময় পাওয়া যায়না। তা’ছাড়া রাশিয়ায় প্রস্তুত এই অস্ত্র দ্বিমাত্রিক। অর্থাৎ একই সাথে সাধারন মিসাইল এবং ব্যালাস্টিক মিসাইল। সুতরাং তারা কখন নিউক্লিয়ার অস্ত্রটি ব্যবহার করবে তা’ অনুমান করা সহজ হবেনা।

যখন নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা খুবই কম তখন পুতিন তার নিউক্লিয়ার ফোর্সদের সতর্ক রেখেছেন যা’ অনেকটা ন্যাটো ইন্টারভেনশন যাতে না হয় তার জন্য একটা  ইনডাইরেক্ট থ্রেট এর সামিল।
নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা তখনই বাড়বে যখন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে এবং পুতিনের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে এবং রাশিয়া যখন যুদ্ধের পথ হারাবে। যদিও সম্ভাবনা একেবারেই কম তবুও অসম্ভব কিছু নয়।

যেটি এখনও অজ্ঞাত তা’ হচ্ছে নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার করলে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কি হবে? যখন সমগ্র বিশ্ব নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে তখন ন্যাটোর বা পশ্চিমা বিশ্বের ফুল-স্কেল নিউক্লিয়ার যুদ্ধে জড়ানো ঠিক হবেনা। বরং Strategic nuclear (long ranged missiles) exchange হতে পারে। কারন, বেশ কয়েকটি দেশের নিউক্লিয়ার উইপনস রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ অবশ্বম্ভাবী।

যুদ্ধ কি সম্প্রসারিত হওয়া উচিত? ন্যাটোর কি যুদ্ধে জড়িত হওয়া উচিত? ন্যাটো এবং রাশিয়া যুদ্ধে জড়ালে বিশ্বে মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ তৈরী হবে। তখন এক পক্ষ অন্য পক্ষের ধ্বংসে মেতে উঠবে। এক্ষেত্রে বরং রাশিয়া ন্যাটোর সাথে কনফ্লিক্ট এড়াতে nuclear doctrine অনুসরন করতে পারে। রাশিয়ার নিউক্লিয়ার ডক্ট্রিন হচ্ছে তারা নিউক্লিয়ার অস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত হলেই শুধু নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার করবে।
কেনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা সরাসরি করতে পারছেনা?
রাশিয়ার কোনো একটি বড় শহর বা দেশ ধ্বংস করে দেয়ার মতো নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মজুদ রয়েছে যা’ তাদেরকে বিরোধী শক্তির কাছে প্রতিরক্ষা দেয়। যদিও এই হিসেব কাগজে-কলমে। বাস্তবে ‘কিন্তু’ রয়েছে।

রাশিয়া মনে করছে ন্যাটো হয়তো কনভেনশনাল কনফ্লিক্টে জড়াতে পারে; নিউক্লিয়ার কনফ্লিক্টে জড়াবেনা। সুতরাং রাশিয়া নিউক্লিয়ার আক্রমনে গেলে ন্যাটো থেমে যাবে। সেক্ষেত্রে হয়তো ভীতি প্রদর্শনে বড় শহর বা জনসমাগম টার্গেট না করে সমুদ্রে , এয়ারফিল্ডে বা ফাঁকা রাস্তায় বা কোনো ফিউয়েল স্টোরেজকে টার্গেট করতে পারে। কিন্তু যেকোনো জায়গায়ই নিউক্লিয়ার মিসাইলস টার্গেট করা হোক না কেনো তখন ন্যাটো দেশগুলোতে জনগনের পক্ষ থেকে পাল্টা আক্রমনের পক্ষে চাপ তৈরী হতে পারে।
ন্যাটোর যেকোনো পর্যায়ের ইন্টারভেনশন মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরী করবে।

রাশিয়ান সরকার নিউক্লিয়ার অস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত না হলে নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার করবেনা বলে তাদের নিউক্লিয়ার ডক্ট্রিনে রয়েছে বলে এখনও বলছে। তারা শুধুমাত্র তাদের আত্মরক্ষার্থে নিউক্লিয়ার মিসাইল ব্যবহার করবে। আগ বাড়িয়ে এই অস্ত্রের ব্যবহার করবেনা। আমেরিকা প্রকাশ্যেই রাশিয়ার নিউক্লিয়ার ডক্ট্রিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। গোপন কোনো মুহূর্ত উভয় পক্ষের মধ্যে তৈরী হতে পারে যা’ তাদেরকে ফুল স্কেলে নিউক্লিয়ার এক্সচেইন্জে নিয়ে যেতে পারে যা’ বিশ্বাসী অবগত নয়।

ন্যাটোর প্রতি ডিম্যান্ড রয়েছে ইউক্রেনের আকাশসীমা নো-ফ্লাইজোন ঘোষনার। প্রাথমিকভাবে দাবীটি যৌক্তিক মনে হতে পারে। যদি সেটা করা হয় তবে ন্যাটোর এয়ারক্র্যাফ্ট ইউক্রেনে এনগেইজ করতে হবে রাশিয়ার বিমানকে শুট ডাউন করার জন্য। তখন কনফ্লিক্টের জাল বিস্তৃত হবে। ন্যাটোর যেকোনো ধরনের ইন্টারভেনশন পৃথিবীকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে টেনে নিবে। তখন সম্ভাব্য ধ্বংসের পরিমান পরিমাপ্যোগ্য নয়।
গত বছরের বিশ্লেষণ। 


শফিকুল আলম / লেখক,সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ 

 

ছবিঃ সংগৃহিত