উপ - সম্পাদকীয়

শুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চার আবশ্যকীয়তা ও অঙ্গীকার - কাজী সুলতানা শিমি

ক্রমশঃ শুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চার বিষয়টা গুরত্ব হারিয়ে ফেলছে এবং ফেব্রুয়ারি মাস এলে এটা খুব হতাশার সৃষ্টি করে। সাধারণ বা গতানুগিক আড্ডায় ভাষা চর্চা বা ভাষার ব্যাবহারের কথা বলছিনা। বলছি বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় কিংবা প্রতিবেদন উপস্থাপনায় বক্তারা যে ভাষার ব্যাবহার বা উচ্চারণ করেন তার কথা। বিকৃত উচ্চারণ ও ভাষার অশুদ্ধতার কারণে দর্শক ও শ্রোতারা প্রকৃত বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানার ও শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং বিরক্ত হয় তা নিয়ে বক্তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

দর্শক ও শ্রোতা কেন বক্তৃতার প্রতি তিক্ত অনুভূতি প্রকাশ করছে এ নিয়ে আদৌ কোন মাথাব্যথা নেই। বক্তৃতা একটি সৃজনশীল নান্দনিক শিল্প। শ্রুতিমধুর ও সাবলীল উচ্চারণ এবং আত্ম-প্রত্যয়ী ভঙ্গিমার মাধ্যমে প্রকাশ করা হলে তা হতে পারে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও প্রনবন্ত। এজন্য প্রয়োজন শুদ্ধ ভাষা চর্চায় উদ্যোগী হওয়া।  

যে কোনকিছুর চর্চা বা অনুশীলন করলেই একসময় তাতে দক্ষ হয়ে উঠা সম্ভব। উন্নত বিশ্বে বা পশ্চিমা দেশে স্কুল লেভেল থেকেই পাবলিক স্পিকিং এবং প্রেজেন্টেশন নিয়ে বেশ গুরত্ব দেয়া হয়। আমাদের দেশে পাবলিক স্পিকিং বা জন সমক্ষে কথা বলার জন্য কোন কোর্স বা ট্রেনিং দেয়া হয়না। মঞ্চে উঠে জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে কিছু আবেগপুর্ন কথা বললেই মনে করা হয় বেশ ভালো বক্তৃতা দেয়া হয়ে গেলো। আসলে কি তাই! দেশ থেকে যখন প্রথম নিউজিল্যান্ডে যাই সেখানকার কর্ম সংস্থান সার্ভিস বা ওয়ার্ক এন্ড ইনকাম” অফিস থেকে প্রথমেই সবাইকে যে কাজটি করতে বলেছিল তা ছিল পাবলিক স্পিকিং বা জন-সমক্ষে কথা বলার ও বায়োডাটা লিখার দক্ষতা অর্জনের ট্রেনিং নেয়া।

এখন মনে হয় আসলেই তো! প্রত্যেকের তাই করা দরকার। বিশেষ করে যারা নেতা হতে চান বা মঞ্চে উঠতে পছন্দ করেন তাদের জন্য বিষয়টা অত্যন্ত জরুরী। জন সমক্ষে কথা বলার মতো উপযুক্ত দক্ষতা ছাড়া এ ধরণের কাজ করে উপস্থিত সবাইকে অহেতুক বিরক্ত করা কতখানি যুক্তিযুক্ত বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। এতে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া তো দুরের কথা বরঞ্চ আগত অতিথিদের সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়।      

বক্তৃতা মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। ব্যক্তিত্বের বিকাশ, নিজের চিন্তাধারার সম্প্রসারণ, স্বীয় আদর্শ, চেতনা ও আবেগ প্রকাশ করার জন্য বক্তৃতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যারা বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা এখনো দিচ্ছেন তাদের বক্তৃতা শুনেই মানুষ উজ্জীবিত হয়েছে, জীবন বিলিয়ে দিয়েছে বা এখনো দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। দেশ জাতি ও মানবতার বৃহৎ কল্যানে আত্মনিয়োগ, সুন্দর, স্বপ্নময় ও কাঙ্খিত সমাজ গঠন করার লক্ষ্যেই নিজেকে সুবক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার। আর এরজন্য সবচে আগে প্রয়োজন শুদ্ধ ভাষা চর্চার উদ্যোগ। আমাদের অন্তর্গত আগ্রহ থেকে তা করা দরকার। বিশেষ করে যখন কোন জন সমাবেশে কথা বলতে হয় তার জন্য যতোটুকু সম্ভব শুদ্ধ ও সাবলীল উচ্চারণ অনুশীলন করে নেয়া খুব দরকার।  

যারা শিল্পসাহিত্য, আবৃত্তি, সঙ্গীত, অভিনয়, রাজনীতি এমন কি শিক্ষকতা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের প্রায়ই মঞ্চে উঠতে হয়। জন সমক্ষে দাঁড়াতে হয়। মাইক্রোফোনে কথা বলতে হয়। এই কথা বলা বা উপস্থাপনা যদি দর্শক-শ্রোতাকে আকৃষ্ট বা মুগ্ধ করে তাহলে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু তাদের বিকৃত উচ্চারণ ও ভাষার অশুদ্ধতার কারণে কিংবা বাক্তিত্তের অসতর্কতায় যদি দর্শক-শ্রোতা বিরক্তবোধ করেন তাহলে সকল প্রস্তুতি ও উদ্যোগ পণ্ড হয়ে যায়। তখন পুরো বিষয়টা হয়ে পরে সমালোচনার। যারা আয়োজক তাদের পড়তে হয় বিব্রতকর অবস্থায়। তাই বক্তৃতা ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া ও শুদ্ধ ভাষা উচ্চারণ করা খুবই প্রয়োজন।
 
বক্তৃতার গ্রহনযোগ্যতার জন্য বক্তার ভাষার উৎকর্ষতা ও সঠিক ব্যবহার অনেক দরকারি একটা বিষয়। দেশী হোক বিদেশী হোক শব্দ উচ্চারনে মনোযোগ দেয়া দরকার। বক্তৃতায় বোধকরি আঞ্চলিকতা বাদ দিয়ে শুদ্ধভাষী হওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ। চিন্তামুক্ত চেহারায় পরিষ্কারভাবে শব্দচয়ন দর্শক ও শ্রোতাদের অনেক বেশী আকর্ষিত করে। ভাষাগত দৈন্যতা পুরো বক্তব্যকে অস্পষ্ট করে ফেলে। নিজের কন্ঠের প্রাণবন্ত উচ্চারন ও আত্মবিশ্বাসের অভাবে বক্তৃতার বিষয়ের গুরুত্ব সঠিক ভাবে অনুধাবন করা যায়না। তাই বক্তৃতা দেয়া ও প্রতিবেদন উপস্থাপনার ক্ষেত্রে দৃঢ় মানসিকতা ও আত্মবিশ্বাসী হওয়া ভীষণ জরুরি।

সত্যি কথা বলতে কি শ্রোতার মনোযোগ ও বক্তৃতার বিষয়ের উপর জোরালো সমর্থন নির্ভর করে বক্তার শুদ্ধ উচ্চারণ ও সাবলীল বাচন ভঙ্গীর উপর। অনমনীয় নয়, সোজা ও স্বাভাবিক ভাবে দাড়িয়ে সুন্দর ভঙ্গীতে শব্দ উচ্চারণ ও ভাষার যথাযথ ব্যবহারের উপর পুরো অনুষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। সামাঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি দিয়েও অনেক সময় পুরো বিষয়টিকে আর্কষনীয় করে তোলা যায়। কার্যকর মাত্রায় শব্দের সংখ্যার ব্যবহার ও দর্শক-শ্রোতাদের দিকে চোখে চোখে তাকিয়ে কথা বললে বক্তব্য হয় অনেক আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য। উচ্চস্বর ও উত্তেজনা এড়িয়ে প্রাণোচ্ছল ও উষ্ণ কণ্ঠে কথা বলেও নিজের বক্তব্য সুন্দর ভাবে প্রকাশ করা যায়।

বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রায়ই দেখা যায় বক্তারা এসব বিষয়ের উপর একেবারেই গুরুত্ব দেন না। এতে অনেক শ্রম ও সময়ের বিনিময়ে যে সভা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয় তার যথাযথ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়না। আমার মনে হয় বক্তৃতা বা কিছু উপস্থাপনে এ ব্যাপারগুলোর অনুশীলন খুব জরুরি। কেবল মঞ্চে দাড়িয়ে কিছু একটা বলতে পারাটাই আত্মতৃপ্তি হওয়া উচিত নয়। তার আগে শুদ্ধ উচ্চারণ ও ভাষার সঠিক ব্যাবহার চর্চা করা দরকার। শুধু সভা সমিতি, সেমিনার, অনুষ্ঠান করেই শেষ নয় বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে হৃদয়য়ের গভীরে, মননে ও চিন্তায় তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও চমৎকার বাচন ভঙ্গী একটি ভাষার প্রাণ। এর উপর ভাষার গ্রহণযোগ্যতাও অনেকাংশে নির্ভর করে। ঘরোয়া আলাপন ও আড্ডায় না হোক অন্তত পেশাগত ও বাহ্যিক পরিবেশে শুদ্ধ ভাষা চর্চা দরকার।  

কাজী সুলতানা শিমি 
লেখক ,সাংবাদিক


বিঃ দ্রঃ মতামত ও মন্তব্য সমূহ লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।