শীর্ষ সংবাদ কমিউনিটি

যেখানে বাঙালি সেখানেই একুশ , হয়ে গেল সিডনির বইমেলা

আবু রেজা আরেফিন: আজ ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হলো। বাঙালি জাতির জন্য এই দিবসটি হচ্ছে চরম শোক ও বেদনার। ১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজ সহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির চোখ-রাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শঙ্কিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক সহ নাম না জানা অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। বাংলাভাষীদের আরও উদ্বেগ ছিল দুটি ভূখণ্ডের মানুষের সাংস্কৃতিক পার্থক্য নিয়ে। শুধু ধর্ম তাদের মধ্যে কতটুক যোগসূত্র স্থাপন করতে পারবে সে নিয়ে ভাবনা ছিল অনেকের।

 

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।

ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী দেওয়ার পাশাপাশি প্রবাস প্রজন্মে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি জাগ্রত রাখার সংকল্প নিয়ে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে  শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়েছে এই প্রবাসে। সিডনির অ্যাশফিল্ড পার্কে নির্মিত আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা স্তম্ভটি পৃথিবীতে নির্মিত প্রথম international Mother Language Monument . মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একুশের বইমেলা এবারোও অনুষ্ঠিত হলো সিডনির অ্যাশফিল্ড পার্কে ১৯ ফেব্রুয়ারী, একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়া আয়োজিত এটি ছিল ২৪ তম বইমেলা।

ঐদিন  সকালে সিডনির এসফিল্ডের পার্কের শহীদ মিনারে ’৫২ এর ভাষা শহীদের স্মরনে সকালে প্রভাত ফেরির আয়োজন করা হয়। সিডনির বিভিন্ন সংগঠন প্রতীকী শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান শহীদদের। সর্ব প্রথমে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়া, এরপর একে একে প্রতীকী শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানান , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন ,বুয়েট এলামনাই এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মেডিকেল সোসাইটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস ,নটর ডেম কলেজ এলামনাই এসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়া , ভিকারুন্নেসা এলামনাই এসোসিয়েশন , বি এস পি সি বাংলা স্কুল , ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই  এসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কিশলয় কচি কাঁচা ,বাংলাদেশ খ্রিষ্টান ফেলোশিপ অফ অস্ট্রেলিয়া , কৃষিবিদ অস্ট্রেলিয়া , পড়ুয়ার আসর, প্রতীতি , বঙ্গবন্ধু পরিষদ অস্ট্রেলিয়া , পেন্সিল অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ প্রেস এন্ড মিডিয়া ক্লাব ,  Distressed Children and Infant International , বাংলাদেশ লেডিস ক্লাব অস্ট্রেলিয়া , জন্মভূমি টেলিভিশন সহ আরো বেশ কিছু সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ পুষ্পস্তবক প্রদান করেন।

অনুষ্ঠানের মূল পর্বে একুশে একাডেমি অষ্ট্রেলীয়ার সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মতিনের সভাপতিত্বে এবং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রনক হাসানের সঞ্চালনায় আলোচনা পর্বে  প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত  ছিলেন শাখাওয়াত হোসেন, কনসুলেট জেনারেল অব বাংলাদেশ সিডনি। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ,ওয়েন্ডি লিন্ডসে , স্টেট এমপি অব ইষ্ট হিলস, কার্ল সালেহ , কাউন্সিলর অব ক্যান্টাবারী-ব্যাংকস্টাউন কাউন্সিল, অষ্ট্রেলীয়া লাইফব্লাডের টিম মেম্বার এসলি হেলস, ইনার ওয়েস্ট কাউন্সিল এর মেয়রের প্রতিনিধি মার্ক ডুরে , ডাঃ জেসি চৌধুরী অস্ট্রেলিয়াতে প্রথম বাংলাদেশী মহিলাচিকিৎসক, শ্রীমন্ত মুখার্জী স্বত্বাধিকারী আনন্দধারা প্রমুখ। বক্তারা বাংলাভাষাকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার উপর গুরুত্ব  আরোপ করেন। তারা উল্লেখ করেন যে প্রতিটি ভাষাই একেকটি সংস্কৃতির ধারক এবং কালের সাক্ষী। সুতরাং আমাদের প্রচলিতএবং অপ্রচলিত প্রতিটি ভাষাকেই সংরক্ষণ করতে হবে।

বইমেলা উপলক্ষে সারাদিন ব্যাপী ছিল নানান আয়োজন। প্রতিবারের মতো এবারও ছিল  ১১ টি বইয়ের ষ্টলে দেশি-প্রবাসী প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের বইয়ের সমাহার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার পরপর শুরু হয় ছোট্ট সোনামণিদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠান। এছাড়া সারাদিন ব্যাপি চলে গান ,কবিতা , নাচ দলীয় সঙ্গীত , নাটক ইত্যাদি । একুশে একাডেমীর শিল্পীরা ছাড়াও বিভিন্ন কমিউনিটিদলের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মত। এদের মধ্যে কবিতার বিকেল, জুম্মা সাংস্কৃতিক দল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কিশলয় এবং বিএসপিএস বাংলা স্কুল এর নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশনা সংস্থা University Press Limited (UPL) এর অংশগ্রহন ছিল উল্লেখযোগ্য

দিনভর আয়োজিত বইমেলা প্রাঙ্গন মুখরিত ছিল বই প্রেমিক প্রবাসী বাংলা ভাষাভাষীদের পদচারণায়। মেলার বিভিন্ন বইয়ের স্টলে বাংলাদেশি-প্রবাসী কবি সাহিত্যিকদের বইয়ের সমাহার ছিল আকর্ষণীয়। এছাড়াও ছিল স্থানীয় লেখক সাহিত্যিকদের আড্ডা। অনুষ্ঠানেই মূল মঞ্চে আরো ছিল নতুন বই প্রকাশনার মোড়ক উম্মোচন,  একুশে একাডেমি অষ্ট্রেলীয়ার নিজস্ব প্রকাশনার ‘মাতৃভাষা’র  মোড়ক উম্মোচন। দুই প্রজন্মের শিল্পীদের সমন্বয়ে ছিল নানান সাংস্কৃতিক আয়োজন। এছাড়া আরো ছিল চিত্র প্রদর্শনী, পেন্সিল অস্ট্রেলিয়ার আয়োজনে ছিল আলোকচিত্র প্রদর্শনী। মেলায় নানান জাতের মুখরোচক দেশীয় খাবারের স্টল। দিনভর এই আয়োজনের শেষ প্রান্তে এসে একুশে একাডেমী অষ্ট্রেলীয়ার সহ-সভাপতি ডঃ সুলতান মাহমুদ ঘোষণা করেন ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে পরবর্তী বইমেলার তারিখ। এটি হবে ২৫ তম  বইমেলা। এ উপলক্ষে একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়া ব্যপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। 
ছবিঃ কৃতজ্ঞতা ,নাইম আব্দুল্লাহ , কাজী রুবেল আলম ,শাখাওয়াত হোসেন বাবু ও আবু তারিক