শীর্ষ সংবাদ

আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’- কাজী নজরুল ইসলাম

আবু রেজা আরেফীন : আজ বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এ দিনে মৃত্যুবরণ করেন চির তারুণ্যের প্রতীক এই কবি। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। ৭৮ বছর বয়েসে  ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন কাজী নজরুল ইসলাম । এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি অসহনীয় নির্বাক জীবন কাটিয়েছেন।

১৯৭২ সালের ২৪ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবি সপরিবারে বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশ সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন এবং জাতীয় কবি হিসাবে ঘোষণা দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। বাংলাদেশে যে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, সেটা কবি সুস্থ থাকলে কি সানন্দচিত্তে মেনে নিতেন? তিনি কিন্তু বহু আগেই বলেছিলেন, ‘এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, আমি শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের।’

নজরুলের কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তার লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।  বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কাজী নজরুল ইসলাম লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন মাত্র ২২ বছর। এই অল্প সময়ে তিনি কবিতা, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ কত কিছুই না লিখেছেন।

নজরুল বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নজরুলের লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল মুক্তিকামী মানুষদের। তিনি পরিচিত হন বিদ্রোহের কবিতে।

ধর্ম নিয়ে নজরুলকে বিদ্রূপ-গঞ্জনা কম সহ্য করতে হয়নি। আক্ষেপ করে কবি লিখেছেন 
‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। 
আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। 
আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, 
গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। 
সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, 
তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, 
আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে বেগ পেতে হবে না।
কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি, আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি।

নজরুল তার কবিতা, গান, উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। সে কারণে ইংরেজ সরকার তার গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করেছে এবং কারাদণ্ড দিয়েছে। কারাগারেও বিদ্রোহী নজরুল টানা ৪০ দিন অনশন করে বিদেশি সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ করেছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের  গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। তাঁর কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তার লেখনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের মাঝে নেই কিন্তু নজরুল রয়ে গেছেন আমাদের মনে। নজরুল আমাদের হতে বলেছেন- উদ্দাম, চঞ্চল, নির্ভয়, স্বচ্ছল, বাধাহীন, বেদুঈন, স্বাধীন। তাই নজরুল লিখেছেন-
মোরা আকাশের মত বাধাহীন
মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,
বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন
চিত্তমুক্ত শতদল।

কবি নজরুল ছিলেন চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই তিনি  অনায়াসেই বলতে পেরেছিলেন , ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’

কাজী নজরুল ইসলাম "অভিশাপ" নামের কবিতায় লিখেছিলেন 
যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে
বুঝবে সেদিন বুঝবে
গাইতে বসে কণ্ঠ ছিঁড়ে আসবে যখন কান্না
বলবে সবাই
‘সেই যে পথিক তার শোনানো গান না?’

১৯৪১ সালে এক সাহিত্য সভায় তিনি বলেছিলেন, 
আমি কবি বলে বলছি না, আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম—সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’
ছবিঃ সংগৃহিত